লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে দেশে কৃষি উদ্যোক্তা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে অন্য সবার মতো চাকরির খোঁজ করছিলেন রুকন উদ্দীন। সালটা ২০১২। এদিক-ওদিক ঘুরেও চাকরি মেলেনি। পরে পড়াশোনার জন্য তিনি চলে যান সাইপ্রাসে। পড়াশোনার ফাঁকে সেখানকার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। বেতন পেতেন লাখ টাকা। কিন্তু কিছুতেই মন টিকছিল না প্রবাসে। পরে দেশে এসে শুরু করেন পেঁপে, তরমুজসহ নানা ফলের চাষ। ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। এখন মাসে আয় লাখ টাকার বেশি।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ৩ নম্বর নারায়ণহাট ইউনিয়নের চানপুরের ধলিয়াপাড়ায় তাঁর বাগানটি যেন সবুজে মোড়ানো। বাগানে গেলেই যে কারও মন ভরে উঠবে। সেখানে কাঁচা-পাকা পেঁপে, তরমুজ, কলা, শসার চারারা মাথা তুলে আছে। প্রায় ৪০ কানি জমিতে গড়ে ওঠা বাগানের নাম দিয়েছেন ‘রুহামা ফ্রুট অ্যান্ড অ্যাগ্রো’।

রুকন উদ্দীনের চাষবাসের শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালের দিকে। তখন তিনি সাইপ্রাসে। ওই বছর রাঙামাটির লংগদুতে ১২ কানি পাহাড়ি জমি ইজারা নিয়ে তিনি শুরু করেন ফলের চাষ। বন্ধু শহীদুল ইসলামের মাধ্যমে ফল চাষের শুরুটা হয়। প্রথমে দুই হাজার পেঁপে, এক হাজার পেয়ারার চারা লাগানো হয়। সাত মাস পরেই ফল পান তাঁরা। বিক্রি হয়েছিল আশপাশের বাজারে। এক বছর পর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আসেন রুকন।

এরপর কী হয়েছিল, তা রুকনের কণ্ঠেই শোনা যাক। ত্রিশোর্ধ্ব এই যুবক বলেন, শখের বশে বাবা-চাচাদের সঙ্গে বাড়ির ফুলের বাগান করেছিলেন সেই ছোটবেলায়। পরিবারের সদস্যরা জড়িত ছিলেন কৃষিকাজেই। ফলে চাষাদের প্রতি আলাদা টান ছিল। তাই মাসে এক লাখ টাকা বেতন ছেড়ে সাইপ্রাস থেকে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে ফটিকছড়িতে পারিবারিক চার কানি জমিতে পেঁপে, কলা, শসা ও তরমুজের চাষ শুরু করেন। প্রথমে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে লাভের মুখ দেখা হয়নি।

রুকনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দেশে ফেরার পর সহযাত্রী শহীদুল ইসলামের সঙ্গে রাঙামাটির পাহাড়ি জমি ও ফটিকছড়িতে সমানতালে চাষবাস চলছিল। ২০১৮ সালের শুরুতে বড় আকারে ফটিকছড়িতে শুরু হয় বাগান করা। কয়েক হাজার করে চারা লাগানো হয়। বছরের শেষ দিকে এসে ফলন আসে। তবে খুব বেশি লেনদেন হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালে এসে সবকিছু ঘুরে যায়।

রুকন জানালেন, ২০২১ সালে এসে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। ওই বছর সব মিলিয়ে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। বাগানের ফল পৌঁছে যায় আশপাশের ফেনি, চট্টগ্রাম নগর, হাটহাজারী, রাউজানসহ বিভিন্ন উপজেলায়। ২০২২ সালে অবশ্য ফলন কম হয়েছিল। সে বছর লেনদেন হয় ১৫ লাখ টাকার মতো। আর এ বছর প্রথম নয় মাসে ১৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। বছর শেষে ২৫ লাখ টাকার মতো লেনদেন থাকবে। ফলে সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে এক লাখ টাকার মতো আয় হচ্ছে।

কৃষির ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় শুরুতে হিমশিম খেতে হয়েছিল রুকনের। কিন্তু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ আর কৃষিবিষয়ক লেখা পড়ে ধারণা নিয়েছেন।

ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বেশ কয়েকবার রুকনের বাগানে গিয়েছেন। তাঁকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। হাসানুজ্জামান বলেন, প্রচলিত বাণিজ্যিক কৃষি ধারণার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রুকন চাষাবাদ করছেন। তিনি মুনাফা করতে পেরেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাগান ঘুরে দেখেছেন রুকন। প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। এ কারণেই তিনি সফল কৃষি উদ্যোক্তা।

রুকনের পরিবারে দুই সন্তান। আরও আছেন মা, ছোট ভাই ও তিন বোন। পরিবারের খরচ এখন তিনি সামাল দিচ্ছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানালেন রুকন। তিনি বলেন, উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের দিকে যাচ্ছেন তিনি। তবে মাটি ও ফসলের চরিত্র ঠিক রেখে তিনি প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি কলা, পেঁপে ও অন্যান্য ফল রপ্তানি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *