Featuredদেশের কৃষি

মরিচ যেভাবে চরাঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে উঠল

এইতো ১৫-২০ বছর আগেও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় চরাঞ্চলে বলার মতো তেমন ফসল হতো না। এখন সেই ধুধু বালুচর পরিণতি হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের চরাঞ্চলে প্রায় ২৫-৩২ রকমের ফসলের আবাদ হচ্ছে। প্রধান অর্থকরী ফসলের মধ্যে আছে মরিচ, ভুট্টা ও মিষ্টি কুমড়া।

এগুলোর মধ্যে মরিচ দীর্ঘদিন ধরে কৃষককে ভালো পরিমাণে অর্থ দিচ্ছে বলে চরে এর চাষের পরিমাণ বাড়ছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার নয়াপাড়া চরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাকের বয়স এখন ৬৫ বছর। তিনি ছোটবেলা থেকে হাটশেরপুর চরাঞ্চলে বাস করছেন। আব্দুর রাজ্জাক এ বছর প্রায় আড়াই বিঘা জমিতে হাইব্রিড মরিচের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় এই পর্যন্ত তিনি ফলন পেয়েছেন ১২০-১৩০ মণ। বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে তিনি প্রতি বিঘায় লাভ করেছেন প্রায় এক লাখ টাকা।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এই ২০ বছর আগেও সেচের ব্যবস্থা ছিল না। চরে কোনো অর্থকরী ফসল হতো না। শুধুমাত্র কাউন, চিনা বাদাম ও ডাল চাষ হতো। এতে করে চরের মানুষের মুখে দুই বেলা খাবার জুটতো না। এখন দিন একেবারেই বদলে গেছে। এখন চরে সেচের ব্যবস্থা হয়েছে। নানান রকমের ফসল হচ্ছে। এই সব ফসলের মধ্যে মরিচ চাষ করে ভালো পয়সা পাওয়া যাচ্ছে।’

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাজে ফুলছড়ি গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান (৬০) বলেন, ‘মাত্র ১৫ বছর আগেও মরিচ থেকে ভালো পয়সা পাওয়া যেত না। কারণ দেশি মরিচের ফলন বেশি ভালো হয় না। হাইব্রিড মরিচ আসার পর এখন বিঘায় ১০০ থেকে ১৩০ মণ মরিচ হচ্ছে। এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা বেশি লাভ হচ্ছে।’

সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুসারে, এই উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন পুরোপুরি যমুনা নদীর চর। এখানে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে এ বছর মরিচের আবাদ হয়েছে তিন হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। ফলন হয়েছে আট হাজার ৭১০ টন শুকনো (লাল মরিচ) মরিচ। এর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা।

বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলায় এ বছর কাঁচা মরিচ চাষ হয়েছে সাত হাজার ২৩৮ হেক্টর জমিতে। এর ৮০ শতাংশ চাষ হয়েছে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চরাঞ্চলে। গত বছর এ জেলায় শুকনো মরিচের ফলন হয়েছিল ২২ হাজার ২৬৩ টন। এর বাজারমূল্য ছিল প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বছর শুকনো মরিচের দাম কম হলেও প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মরিচ উৎপাদন হয়েছে।

কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, দেশের মোট পাঁচ শতাংশ মরিচের চাষ হয় বগুড়ায়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ হয় সারিয়াকান্দি উপজেলায়।

সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, ‘সারা দেশে বগুড়ার লাল মরিচের সুনাম আছে। বগুড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো মরিচ হয় সারিকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলে। কারণ এই অঞ্চলটি এগ্রি ইকোলজিক্যাল জোনে পড়েছে। এটি মরিচ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।’

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৯০ দশকে বগুড়ায় হাইব্রিড মরিচের চাষ শুরু হয় তবে তা খুব সামান্য পরিমাণে। ২০০৪ সালে সরকার এই অঞ্চলের চরের মানুষের দরিদ্রতা দূর করতে ‘চর লাইভলিহুড প্রোগ্রাম (সিএলপি)’ বাস্তবায়ন করে। তখন থেকে উন্নতমানের ফসলের বীজ চরের কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সেই থেকে চরে মরিচ চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।’

শুধু বগুড়ায় নয় উত্তরাঞ্চলের যেসব জেলার ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও যমুনা বয়ে গেছে সেই সব জেলার চরাঞ্চলে প্রতি বছর মরিচের আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে।

গাইবান্ধার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এই জেলায় চর আছে প্রায় ১৬৫টি। এর মধ্যে যেসব চরে সেচের সুবিধা আছে সেসব চরে মরিচের চাষ হচ্ছে। এ বছর গাইবান্ধার চরাঞ্চলে প্রায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। এর বাজার মূল্য আনুমানিক ১২০ থেকে ১৪০ কোটি টাকা।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘ধান চাষে খুব লাভ হয় না। ভুট্টা ও মরিচ গাইবান্ধার কৃষকের প্রাণ। মরিচে সেচ কম লাগে তাই চরাঞ্চলে মরিচের চাষ বাড়ছে। বর্তমানে মরিচ চরাঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল। তবে চরে অস্থায়ী সোলার পাম্প দিতে পারলে আরও বেশি ফসল ফোলানো সম্ভব।’

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, ‘কুড়িগ্রামে চরের সংখ্যা প্রায় ৩৬৪টি। এ বছর জেলায় মরিচের চাষ হয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। এর প্রায় ৮০ শতাংশ চরাঞ্চলে। মরিচে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক এর চাষ বাড়িয়েছেন। গত বছরের তুলনায় কুড়িগ্রামে প্রায় ১০০ হেক্টর বেশি জমিতে মরিচের চাষ বেশি হয়েছে।’

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় বছরে তিনবার মরিচের চাষ হয়। এর মধ্যে গরমে দুইবার (খরিপ-১ ও খরিপ-২) এবং রবি ফসল হিসেবে শীতে একবার।

উৎপাদিত মরিচের প্রায় ৬০ শতাংশ কাঁচা মরিচ হিসেবে দেশের অন্যান্য জেলায় পাঠানো হয়। বাকি ৪০ শতাংশ মরিচ শীতের শেষে শুকিয়ে (লাল মরিচ/শুকনো মরিচ) বিক্রি করা হয়। দেশের দুইটি বড় মসলা প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান প্রাণ ও স্কয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছর বগুড়ার চরাঞ্চল থেকে প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টন শুকনো মরিচ (লাল) সংগ্রহ করে।

বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) গত ২০১৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১৬ জেলায় ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর চরস’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর উদ্দেশ্য হলো চরের কৃষকদের সেবা দেওয়া। উৎপাদনের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং উৎপাদিত পণ্য যাতে সঠিক দামে বিক্রি করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা।

এই প্রকল্পের পরামর্শক মো. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘চরের কৃষকরা যাতে উন্নত মানের মরিচ চাষ করতে পারেন সে জন্য বড় বড় বীজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরাঞ্চলে নিয়ে গেছি। এরপর ফসল হলে যাতে তারা ন্যায্য দাম পায় সেই জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে চরাঞ্চলের কাছে নিয়ে গেছি।’

তিনি জানান, ২০১৬ সালে প্যাকেটজাত মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ও স্কয়ারের সঙ্গে দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হয়েছে যাতে তারা চরে উৎপাদিত মরিচ কেনে। এখন পর্যন্ত প্রাণ ও স্কয়ার বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের চরাঞ্চল থেকে মরিচ কিনছে।

শুধু সারিয়াকান্দি থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে প্রায় ৪৫০ টন শুকনো মরিচ কিনে থাকে।

এর বাইরে শুধু সারিকান্দি থেকে প্রায় ২০-২৫ মৌসুমি ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে পাকা মরিচ কিনে চাতালে শুকিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

এমনই একজন ব্যবসায়ী বগুড়া সারিকান্দি উপজেলার আব্দুস সালাম। তিনি এ বছর প্রায় ৮০০ মণ পাকা মরিচ কিনে চাতালে শুকিয়ে পাশের জেলাগুলোর ব্যবসায়ীদের কাছে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন।

গাইবান্ধার ফুলছড়িতে সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে। প্রতি হাটে উপজেলার প্রায় ৩০ চরের গ্রাম থেকে কৃষকরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় এক কোটি টাকার মরিচ বিক্রি করেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান।

তবে মরিচ চাষে সবটাই সফলতার গল্প নয়। কিছু হতাশার গল্পও আছে। অনেক সময় নকল বীজের কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু, এর সমাধান মিলছে না।

সারিকান্দির বরইকান্দি চরের কৃষক সাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর তিন বিঘা জমিতে হাইব্রিড মরিচের চারা লাগিয়েছিলাম। গাছ খুব ভালো হয়েছে কিন্তু মরিচ ধরেনি। অন্যরা অনেক ভালো ফলন পেলেও আমি ১০ মণ মরিচও পাইনি। অথচ এক বিঘা জমির জন্য প্রায় ১০ হাজার টাকা দিয়ে চারা কিনতে হয়।’

কোথায় থেকে চারা কিনেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর থেকে চারা সংগ্রহ করেছিলাম।’

বগুড়ার সাজাপুর এলাকায় প্রায় ২৫০ নার্সারি আছে। এখানে প্রতি বছর প্রায় ৩-৪ কোটি টাকার সবজির চারা করা হয়। সেগুলো প্রায় ২৮ জেলার কৃষকদের কাছে যায়।

সাজাপুর নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কৃষকরা যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করতেন তাহলে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই নার্সারি মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’

এ বিষয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, ‘কৃষকরা আমাদের কাছে অভিযোগ দেননি। তারপরও তদন্ত করে দেখবো।’

চাষী সেবা ডেস্ক

Leave a Reply