বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম খাত হলো কৃষি। জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অপরিসীম। আর তাইতো কৃষি বান্ধব এ সরকার কৃষি খাতকে দ্রুত উন্নতির লক্ষে সারা দেশে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন প্রশিণের ব্যবস্থা করে তাদের অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলনে দ ও অভিজ্ঞ করে গড়ে তোলছে। তার পাশাপাশি কৃষকদের হাতের কাছে সব ধরনের কৃষি সেবা পৌঁছে দিতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমের ব্্যবস্থা করছে সরকার।
সাতটি রঙের বড় ছাতার নিচে আড়াআড়ি বসানো টেবিল। মুখোমুখি কয়েকটি প্লাস্টিক চেয়ার। দুটিতে বসা বিজ্ঞ দু’জন কৃষিবিদ। আর টেবিলের উপর রাখা বিভিন্ন প্রজাতির ফল-ফসলের লতাগুল্ম, কান্ড, ফল যা নেড়ে দেখছেন। কৃষকের নিকট রোগের বর্ণনা শুনে প্রেসক্রিশন (ব্যবস্থাপত্র) লিখছেন। লাইনে দাড়ানোদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এখানে রোগী গাছ, লতাপাতা, ফল ও সবজি। ডাক্তার প্রশিণপ্রাপ্ত কৃষিবিদরা। সারিতে দাড়ানোরা কৃষক। উদ্ভিদ চিকিৎসার এ কেন্দ্রের নাম প্লান্ট ডক্টর কিনিক বা উদ্ভিদ রোগ নিরাময় কেন্দ্র। যা বর্তমান কৃষি উন্নয়নে কৃষকদের বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে ব্যাপক সাড়া যাগিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাইলট প্রকল্পের আওতায় দেশের ১০টি জেলার প্রত্যেক জেলার দুইটি উপজেলা করে মোট ২০ উপজেলাতে প্লান্ট ডক্টর কিনিকের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি বিষয়ক পরামর্শ সেবাসহ ব্যবস্থা পত্র দিচ্ছেন প্রশিক্ষিত প্লান্ট ডাক্তার কৃষিবিদরা। আর এই কিনিকের সেবা নিয়ে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন হাজারো প্রান্তিক সব কৃষক পরিবার। এতে কৃষকের ফসল উৎপাদনে সময়, শ্রম ও টাকা অনেকাংশে কম লাগছে। এই প্লান্ট ডক্টর কিনিকের সেবা নিয়ে বিষমুক্ত নিরাপদ ফল, ফসল ও শাক সবজি উৎপাদন করছেন কৃষকরা। কৃষি কিটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে বাড়ছে জৈব বালাই নাশকের ব্যবহার। ফলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক, অপরদিকে দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধিতে অনন্য অবদান রাখছে কৃষি।
এ কিনিকে কৃষকের সাথে আলাপে আলাপে উন্নত চাষাবাদ ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ফল ও মাঠফসল উৎপাদনের বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ সেবা দেওয়াসহ ফল ও ফসলে যে কোন রোগ বালাইয় দমন ও মাঠ ফসলে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে লিখিত ব্যবস্থা পত্র। তাই দিন দিন এই কিনিক কৃষকদের কাছে হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। একই রকম রোগ বালাই বা সমস্যা যদি কয়েক কৃষকের জমিতে দেখা যায় তবে ঐ এলাকার সকল কৃষকদের সতর্ক করে এবং তা দমনের জন্য কিনিক থেকে দেওয়া ব্যবস্থা পত্র। আর এতে করে এলাকার কৃষক ঐ রোগ সম্পর্কে আগাম সতর্ক থাকে তাতে জমির ফসলের ক্ষতি কম হয়। ফলে বেশি চাপ পেতে হয় না প্লান্ট ডক্টর কিনিক পরিচালনাকারী কৃষি ডাক্তারদের (কৃষিবিদ)।
বিভিন্ন রোগ ও পোকা দমনে কিটনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি মাছি পোকা দমনে সেক্স ফেরোমন পদ্ধতি গ্রহনের ও পরামর্শ দেওয়া হয় কৃষকদের। কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা দমন করা যায়। অধিকাংশ কৃষক কীটনাশক বিভিন্ন দোকানে সার বীজ ডিলারের কাছে শুনে পোকা বা রোগ দমনে বিভিন্ন কোম্পানীর বিষ প্রয়োগ করে থাকে। এতে করে দোকানদার বিষের সাথে অপ্রয়োজনীয় সার ও হরমোন কৃষককে প্রয়োগ করতে বলে অধিক অর্থলুটে নেয়। কিন্তু প্লান্ট ডক্টর কিনিকে কৃষক স্বল্প খরচে প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে রোগ বালাই দমনে পরামর্শ নিয়ে জমিতে ফসল ফলাচ্ছে। যাতে একদিকে বিষ মুক্ত ফসল উৎপাদন করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমনই অন্য দিকে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাচ্ছে। আর অতিরিক্ত কিটনাশক প্রয়োগ না করার ফলে উপকারি পোকা নির্বিচারে নিধনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফল-ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্লান্ট ডক্টর কিনিক কার্যক্রম চলছে দেশের ২০ উপজেলার মধ্যে শেরপুর জেলার নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলাতেও। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। প্রত্যন্ত গ্রামে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সফল হতে চলছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। কৃষকের হাতের কাছে মুহুর্তের মাঝে পৌঁছে যাচ্ছে কৃষি সেবা কার্যক্রম। এরই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের মে মাস হতে শেরপুর জেলার নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলার দুইটি করে ব্লকে প্লান্ট ডক্টর কিনিকের মাধ্যমে কৃষিবিদরা কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে আসছে। নকলা-নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ পর্যন্ত তিন সহস্রাধিক কৃষক পরিবার এ প্লান্ট ডক্টর কিনিকের ব্যবস্থা পত্র নিয়ে তাদের নির্দেশ কাজে লাগিয়ে ফসলের ফলন বৃদ্ধি ও কিটনাশক ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
নকলা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, উপজেলায় ৩২ হাজার ৪৫টি কৃষক পরিবার রয়েছে। যাদের হাতে নাগালে কৃষি সেবা পৌঁছে দিতে কৃষকদের কৃষিপ্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সেবা দানের সুবিধার্থে উপজেলায় পৌরসভায় একটি ব্লক ও প্রতেক ইউনিয়নে ৩টি করে ৯টি ইউনিয়নে ২৭টি ব্লকসহ মোট ২৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে বলে জানান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর। তিনি আরও জানান, উপজেলার ২৮ টি ব্লকের মধ্যে পাইষকা ও গৌড়দ্বার ব্লকে ২০১৫ সালের মে মাস হতে প্রতিমাসের ৪দিনের মধ্যে ২দিন পাইষকা ব্লকে ও ২ দিন গৌড়দ্বার ব্লকে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় কৃষিবিদদের সমন্বয়ে প্লান্ট ডাক্তার কিনিকের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার কৃষককে ফল ও ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাইসহ নানা সমস্যায় করণীয় সম্পর্কে ব্যবস্থা পত্র দেওয়া হয়েছে।
পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে, কৃষিতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রামের সকল কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়াসহ কৃষি উন্নয়ন আরও এগিয়ে নিতে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাছাড়া ১৪২টি কৃষক মাঠ স্কুলের মাধ্যমে বিগত বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার কৃষক কৃষানিকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে প্রশিণ দেওয়া হয়েছে।
নকলা উপজেলা প্লান্ট ডক্টর কিনিকের কো-অর্ডিনেটর ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, প্লান্ট ডক্টর কিনিকের মাধ্যমে সেবা নিয়ে কৃষক লাভবান হচ্ছে। যেখানে কৃষকের ফসল ফলাতে শ্রম ও খরচ কম লাগছে। তবে প্রতিটি ব্লকে ছোট করে হলেও একটি করে প্লান্ট ডক্টর কিনিক ভবন করে দিলে কৃষকরা আরও বেশি উপকৃত হতো বলে মনে করছেন সর্বসাধারণ।