গুটি থেকে আমে পরিণত হতে শুরু করেছে মুকুল। এসময় বাড়তি যত্ন বিশেষ করে সেচ, পোকামাকড় ও রোগ দমনে সচেতন হলে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত আমের ফলন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আমের মৌসুমে আম চাষীরা নানা ধরনের সমস্যায় পড়ে, যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো আমের গুটি ঝরা। আম গাছে গুটি আসার পর বিভিন্ন কারণে তা ঝরে যায়। তাই এসব কারণ ও প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে চাষীদের জেনে রাখা দরকার।
প্রাকৃতিক কারণ: আম গাছে প্রতি মুকুলে ১ হাজার থেকে ৬ হাজারটি পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী ফুল থাকে। তারমধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রতি থোকায় জাত ভেদে এক থেকে ৩০টি আমের গুটি ধরতে দেখা যায়। গুটি আসার ২৫-৫০ দিনের মধ্যে প্রতি থোকায় মাত্র এক-দু’টি গুটি থাকে। বাকি গুটি প্রাকৃতিক বা অভ্যন্তরীণ কারণে ঝরে যায়। তবে কোন কোন মুকুলে চার-পাঁচটি আম ধরতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমের আকার ছোট হয়।
প্রতিকার: অতিরিক্ত গুটি ঝরে না পড়লে আমের আকার ছোট হয়। ফলে আমের গুণগতমান ও ফলন কমে যায়। প্রতিটি মুকুলে একটি করে গুটি থাকলে সে বছর আমের বাম্পার ফলন হয়। তবে প্রতি মুকুলে আমের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ফুল ফোটার ১০-২০ দিন পর দুইবার দশ লিটার পানিতে ৬ গ্রাম হারে বোরিক অ্যাসিড স্প্রে করলে ভালো হয়। এছাড়া সব ফুল ফোটা অবস্থায় জিবেরেলিক অ্যাসিড প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম হারে স্প্রে করলে আমের গুটি ঝরা কমে যায়।
মাটিতে রসের অভাব: মাটিতে রসের অভাব হলেও আমের গুটি ঝরে যায়। আমের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাটিতে রসের অভাব দেখা দেয়। মাটিতে রসের অভাব হলে আমের বোঁটায় তাড়াতাড়ি নির্মোচন স্তর গঠিত হয়। ফলে আমের গুটি ঝরে যায়।
প্রতিকার: মাটিতে রসের অভাবে আমের গুটি ঝরে গেলে গাছের চারপাশে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। আমের গুটি মটরদানার মতো হলেই প্রথমে একবার গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচ দেওয়ার পর থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। সেচের পাশাপাশি হরমোন প্রয়োগ করেও আমের গুটি ঝরা কমানো যায়। আমের গুটি মটরদানার মতো হলে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার অথবা প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার হারে প্লানোফিক্স হরমোন পানিতে মিশিয়ে হালকা সূর্যের আলোয় আমের গুটিতে স্প্রে করলে গুটি ঝরা কমে যায়।
পোকার আক্রমণে: গুটি আসার পর প্রাথমিক পর্যায়ে আমের গুটিতে হপার পোকার আক্রমণ হতে পারে। এ পোকার পূর্ণবয়স্ক মথ ও কিড়া গুটির রস শোষণ করে খায়, ফলে আমের গুটি শুকিয়ে ঝরে যায়।
প্রতিকার: গুটি মটরদানার মতো হলেই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একসাথে পানিতে মিশিয়ে গুটিতে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশকের মধ্যে সাইপরমেথ্রিন ১০ ইসি বা ল্যামডা সাই হ্যালাথ্রিন ২.৫ ইসি বা ফেন ভেলারেট ২০ ইসি গ্রুপের যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে এবং ছত্রাকনাশকের মধ্যে মেনকোজেব ৮০ ডচ গ্রুপের যে কোন একটি প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে একসাথে মিশিয়ে গুটিতে স্প্রে করতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকা: আমের গুটি মার্বেল আকৃতির হলে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হতে পরে। এ ক্ষেত্রে পূর্ণবয়স্ক পোকা আমের নিচের অংশে খোসার ওপরে ডিম পাড়ে। কয়েক দিনের মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং লার্ভা খুব ছোট বিন্দুর মতো ছিদ্র করে আমের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্রথমে শাঁস ও পরে আঁটি খাওয়া শুরু করে। পরে আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে যায় এবং কোনো কোনো সময় আম ঝরে পড়ে।
প্রতিকার: এ সমস্যা দেখা দিলে আমবাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এমনকি গাছের মরা ডালপালা ছেঁটে ফেলতে হবে।
উইভিল পোকা: উইভিল পোকা দমনের জন্য গাছের গোড়াসহ চারদিকের মাটি চাষ করে দিতে হবে এবং আগাছামুক্ত রাখতে হবে, যাতে ওই পোকার পুত্তলি মাটিতে লুকিয়ে থাকতে না পারে। এতে রোদের তাপে পোকা মারা যাবে বা পাখি খেয়ে নষ্ট করে দেবে।
উইভিল পোকার আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত গাছের মরা, পোকাক্রান্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে দিতে হবে।
তবে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি. হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/সিমবুস/ফেনম/বাসাথ্রিন) ১০ ইসি জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে গাছের কাণ্ড, ডাল ও পাতায় ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে।
আমে রোগের আক্রমণ: আমের মুকুলের ন্যায় গুটি যখন মটর দানার মত হয় তখন, অ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণ হতে পারে। আমের ছোট মটর দানায় অ্যানথ্রাকনোজ রোগ হলে আমের গায়ে কালো দাগ দেখা যায়। এ অবস্থায় কচি ফল ঝরে পড়ে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ: আমের আকার মটর দানার মত হলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি. টিল্ট-২৫০ ইসি অথবা ২ গ্রাম ইন্ডোফিল এম-৪৫ মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া গাছের নিচ থেকে মরা পাতা কুড়িয়ে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।